আজকের গুলশান আগে ছিল চাষিদের ভোলা গ্রাম

রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত আবাসিক  এলাকাগুলোর তালিকা করতে বলা হলে একদম শুরুতেই উচ্চারিত হবে গুলশানের নাম। এ যেন ঢাকার বুকে এক টুকরো নিউ ইয়র্ক কিংবা লন্ডন।

অত্যাধুনিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল অনুষঙ্গই যথেষ্ট পরিমাণে মজুদ রয়েছে এখানে। রাস্তায়ও সাধারণ প্রাইভেট কারের চেয়ে হ্যামার, রেঞ্জ রোভার, মার্সিডিজ বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ, টয়োটা প্রিমিও কিংবা রোলস রয়েসের মতো বিলাসবহুল গাড়িই চোখে পড়ে বেশি, যা এখানকার অধিবাসীদের আর্থিক সামর্থ্যের দিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার কী, জানেন? গত শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্তও এই এলাকার না ছিল অভিজাত দশা, না ছিল এর ‘গুলশান’ নামটি। বরং এটি ছিল নিতান্তই একটি গণ্ডগ্রাম। স্থানীয়রা যে গ্রামকে চিনত ‘ভোলা গ্রাম’ নামে।

বর্তমান গুলশানে গিয়ে এ নামের অস্তিত্ব হয়তো খুঁজে পাবেন না অনেকেই। সবেধন নীলমণি হিসেবে রয়েছে কেবল দক্ষিণ বাড্ডায় স্থানান্তরিত ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু তা দেখেও অনেকেরই বিশ্বাস হতে চাইবে না, গোটা এলাকাটির নামই কোনো এক সময়ে ছিল ভোলা গ্রাম।কিন্তু না, ভোলা গ্রামের অস্তিত্ব পুরোপুরি মহাকালের অতল গহীনে বিলীন হয়েও যায়নি। গুলশানের স্থানীয় তহশিল অফিসে তল্লাশি চালালে খুঁজে পাওয়া যাবে ‘ভোলা সামাইর’ নামক মৌজার উল্লেখ, যেটিরই বহুল প্রচলিত ডাকনাম ছিল ভোলা গ্রাম।

অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন জাগছে, ভোলা তো বরিশাল বিভাগের একটি দ্বীপের নাম, যেটি বর্তমানে একটি জেলাও বটে। তাহলে কি সেই ভোলার সাথে এই ভোলা গ্রামের কোনো যোগসূত্র আছে?

এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচকই হবে। আসলেই ভোলা দ্বীপের সাথে যোগাযোগ রয়েছে ভোলা গ্রামের। এ গ্রামটি যখন মূল ঢাকার বাইরে ছিল, তখন তা ছিল মূলত একটি কৃষিপ্রধান এলাকা। আর এখানে যারা চাষবাস করত, তাদের অধিকাংশই এসেছিল ভোলা দ্বীপ থেকে। ভোলা দ্বীপের বাসিন্দাদের আধিক্যের কারণেই ঢাকা শহরের মানুষদের মুখে মুখে গ্রামটি ভোলা গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

কেমন ছিল আদি ভোলা গ্রাম? এখনের মতো আধুনিক ঝাঁ চকচকে কিছু তো নয় অবশ্যই, বরং গাছপালায় ঘেরা সুনসান নীরব এক জনপদ ছিল সেটি। মানুষজনও ছিল নিতান্তই কম। বাইরে থেকেও খুব বেশি মানুষজন এসে ভিড় করত না এই গ্রামে।রাতে ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসত শেয়ালের ডাক, ঠিক যেমনটি হতো আবহমান গ্রামবাংলার আর দশটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এমনকি ষাটের দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত এই গ্রামের বনে-জঙ্গলে মেছো বাঘের দেখা পাওয়া যেত বলেও কথিত রয়েছে।

কিন্তু পাকিস্তান আমলের এক পর্যায়ে ছায়া সুনিবিড় এই গ্রামটির দিকে নজর পড়ে যায় ঢাকার ধনাঢ্য সৌখিন মানুষদের। বসবাসের জন্য তারা তো এমনই একটি নিরিবিলি এলাকার খোঁজে ছিল। এদিকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীরও মনে ধরে যায় গ্রামটি। তাই ১৯৬১ সাল নাগাদ গ্রামটিকে অধিগ্রহণ করে সেখানে একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নেন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি)-র প্রথম চেয়ারম্যান, পাকিস্তানি আমলা জি এ মাদানি।

এ পর্যায়ে এসে নতুন একটি সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয় এর নাম। একটি গ্রামের নাম না-হয় ভোলা গ্রাম হতেই পারে, কিন্তু সৌখিন, সম্পদশালী মানুষেরা একত্র হয়ে যে আধুনিক উপশহর গড়ে তুলতে চাইছে, সেটির নাম কি আর ‘ভোলা’ রাখা যায়? তাই খোঁজ চলতে থাকে নতুন কোনো ‘আধুনিক’ নামের। এবং শেষমেষ তার সন্ধানও মেলে।

Image source: Youtube

পাকিস্তানের করাচিতে ছিল গুলশান নামের একটি অভিজাত এলাকা। মাদানি সাহেব মনস্থির করেন, ঢাকাস্থ অভিজাত এলাকাটির নামও রাখা হবে গুলশান, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘ফুলের বাগান’।

তবে শুধু নাম গুলশান রেখেই ক্ষান্ত হয়নি তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। তারা চেষ্টা চালাতে থাকে নতুন এই গুলশানের চেহারাও হুবহু করাচির গুলশানের মতো করে তোলার। সে উদ্দেশ্যে তখনকার দিনের অভিজাত মানুষেরা মোটা অঙ্কের টাকায় এখানে জমি কিনে এক-দোতলার ছবির মতো সুন্দর সব বাড়ি তৈরি করতে থাকে।

কেউ কেউ আবার বাড়ির সামনেটা সাজিয়ে নেয় গল্প-আড্ডা ও খেলাধুলার উপযোগী করে। অনেকে বাড়ির সামনে গড়ে তোলে ফুলের বাগানও। এভাবেই অভিজাত মানুষদের হাত ধরে গুলশান হয়ে ওঠে আক্ষরিক অর্থেই গুলশান, আর হারিয়ে যেতে থাকে এর প্রাক্তন নামটি।

শুধু কি নামটুকুই হারিয়ে যায়? না, একই দশা হয় ভোলা গ্রামের সাধারণ গৃহস্থ মানুষেরও। গুলশান গড়ে তুলতে গিয়ে তাদের উপর চরম অবিচার করে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। আধুনিক গুলশান গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভোলা গ্রামের আদি বাসিন্দাদের কাছ থেকে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হতে থাকে। অথচ তাদেরকে দেয়া হয় না একটা কানাকড়িও।

আদি বাসিন্দাদের জমির ক্ষেতখামার, পুকুর ভরাট করে আর গাছপালা কেটে গড়ে তোলা হয় আধুনিক গুলশান। ফলে বাস্তুচ্যুত হয় শত শত পরিবার। তাদের আর মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পর্যন্ত ছিল না। ফলে তারা ঢাকার অদূরে গাজীপুরসহ অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে।

কিন্তু সেখানেও তারা ছিল বহিরাগত। তাই তাদের অধিকাংশই আর নতুন করে গৃহস্থ হতে পারেনি। ছোটখাটো ব্যবসা কিংবা দিনমজুরের কাজ করে দিন গুজরান করতে থাকে তারা। আর তাদের উত্তরসূরীদের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। বরং কারো কারো অবস্থা তো আরো করুণ। জীবিকার তাগিদে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নিতে হয়েছে তাদেরকে।

002222
Image Source: Kaler kontho News Paper

এদিকে শুরুর দিকে অভিজাত মানুষেরা গুলশানে এসে বাড়ি তৈরি করতে থাকলেও, এর প্রশাসনিক ও কাঠামোগত উন্নয়ন কিন্তু রাতারাতি সম্ভব হয়নি। কারণ গুলশান যখন ভোলা গ্রাম ছিল, তখন এখানে ছিল না আধুনিক জীবনযাপনের প্রায় কিছুই। শুধু ছিল ১৯২৫ সালে স্থাপিত একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (যেটি বাড্ডায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে), আর ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ভোলা জামে মসজিদ (যা বর্তমানে গুলশান জামে মসজিদ নামে পরিচিত)।

তাই ষাটের দশকে ডিআইটি চেয়ারম্যান যখন ভোলা গ্রাম অধিগ্রহণ করে গুলশান বানিয়েছিলেন, সেখানে বাস, সেতু, সড়কবাতি, থানা-পুলিশ, নিরাপত্তা, স্কুল-কলেজ, বাজার- বলতে গেলে কোনো কিছুই ছিল না। এমনকি লোকজনকে তখন মহাখালী থেকে গুলশান হেঁটে যাতায়াত করতে হতো।0222

তাই ডিআইটি চেয়ারম্যানের সামনে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ ছিল গুলশানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন। সে লক্ষ্যে তিনি এই এলাকার আশেপাশের লেকগুলোকে খনন করে তার মাঝে রেস্তোরাঁ ও রিংরোড বানানোর পরিকল্পনা করেন। এরপর গুলশানে তিনি একে একে সেতু, বাজার, সড়কবাতি সবকিছুই তৈরি করেন। থানা না হলেও পুলিশ আর্ম ফোর্সের ব্যবস্থা করেন তিনি।

এভাবে ধীরে ধীরে গুলশানের সামগ্রিক উন্নতি সাধিত হতে থাকে। প্রথমে এটি একটি ইউনিয়ন, এবং পরে পৌরসভায় পরিণত হয়। ১৯৭২ সালে, অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গুলশানসহ আশপাশের এলাকা নিয়ে গুলশান থানা গঠিত হয়। তবে ঢাকা পৌরসভার সাথে যুক্ত হতে গুলশানকে অপেক্ষা করতে হয় আরো দশ বছর। ১৯৮২ সালে গুলশান প্রথম গড়ে ওঠে ঢাকা পৌরসভার একটি ওয়ার্ড হিসেবে।

তবে শুরুর গুলশানের সাথে কিন্তু বর্তমান গুলশানের আকাশ-পাতাল তফাৎ। নিরিবিলি, ছিমছাম একটি এলাকা ছিল বলেই এটি মন কেড়েছিল অভিজাত মানুষদের। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গুলশান লেকও ছিল তাদের হৃদয় কাড়ার অন্যতম কারণ। একই কারণেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একের পর এক বিদেশী দূতাবাসও গুলশানকেই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু আশির দশকের পর আর এই রূপ ধরে রাখতে পারেনি গুলশান।

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই এই এলাকায় একতলা-দোতলা বাড়ির পরিবর্তে গড়ে উঠতে থাকে বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা। বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানির লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয় গুলশান। পাশাপাশি ঢাকাও তো ক্রমশ গুলশান ছাড়িয়ে আরো উত্তরে বিস্তার লাভ করতে থাকে। সব মিলিয়ে গুলশানের পক্ষেও আর নিজের ইতোপূর্বের সুনাম ধরে রাখা সম্ভব হয়নি, বরং সে-ও হয়ে উঠেছে ঢাকা শহরের আরো একটি ব্যস্ততম এলাকা। নামে আবাসিক এলাকা হলেও, বাণিজ্যিক ভবনের আগ্রাসনে এখন পর্যুদস্ত একসময়কার বনেদি এই এলাকা, যানজট আর শব্দদূষণ যার নিত্যসঙ্গী।

কে ভাবতে পেরেছিল, এক সময়কার ভোলা গ্রামের রূপ আজ এমন হবে!